২০১৫ র ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় সরকার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে তৈরি হওয়া দূষণ কমাতে এক বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল। কিন্তু গত সাত বছরে রাজ্যে একটিও কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্ৰ সালফার ডাই-অক্সাইডের (এসও২) মতো গ্যাস অপসারণ করার প্রযুক্তি প্রয়োগ করে উঠতে উদ্যোগী হয়নি। কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত সালফার ডাই-অক্সাইড (এসও২), নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড (এনও২ ) এবং পারদের মতন দূষিত পদার্থের অপসারণ দূর করার জন্য এবং পারটিকুলেট পদার্থের (পিএম) বা সূক্ষতর ধূলিকণার অপসারণ কমানোর জন্য এবং তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে জলের প্রয়োগ নির্ধারিত করার লক্ষে ভারতের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য সর্বোপ্রথম ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে দূষণ নিয়ন্ত্ৰণ মানক নিয়ে আসা হয়।
যেহেতু রাজ্য সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উপরেই নির্ভরশীল, তাই পশ্চিমবঙ্গের মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে তৈরি হওয়া দূষণের প্রভাব দিনে দিনে বাড়ছে। রাজ্যের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলোর মধ্যে ৪০ শতাংশ এখনো পর্যন্ত Flue gas desulphurization বা এফজিডি প্রযুক্তি ব্যবহার করে দূষণ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কোন উদ্যোগ নিয়ে উঠতে পারেনি, যার অর্থ হল, উৎস স্থলে দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য এখনো পর্যন্ত কোনরকম উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি এন্ড ক্লিন এয়ার (CREA) এর করা একটি একটি রিপোর্টে এই তথ্যটি পাওয়া গেছে।
শুধুমাত্র তাই নয়, বাকি ৬০ শতাংশ উৎপাদন ইউনিটও নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে দূষণ অপসারণ প্রযুক্তির প্রয়োগ করে উঠতে পারেনি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে এই নির্ধারিত সময়সীমা গত সাত বছরে তিনবার পিছনো হয়েছে। কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির দূষণ শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছাকাছি এলাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং বাতাসের মাধ্যমে এই দূষণ বহুদূর পর্যন্ত যেতে সক্ষম। এবং এই দূষিত বাতাস সকলের স্বাস্থ্যের জন্যই ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। বিশেষত শিশু, বয়স্ক এবং গর্ভবতী মায়েদের জন্য এই দূষণ ভীষণভাবে ক্ষতিকারক। কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনের মোট ১৩৬৮৬ মেগাওয়াটের মধ্যে গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত কোন বড় ইউনিটই এখনো পর্যন্ত এফজিডি (যা কিনা সালফার ডাই-অক্সাইডের মতো গ্যাস অপসারণ করতে কাজে লাগে) বা ডাইরেক্ট সরবেন্ট ইনজেকশন (ডিএসআই) প্রযুক্তি, যা কিনা সালফার ডাই-অক্সাইডের অপসারণ নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে, তা লাগিয়ে উঠতে পারেনি। সর্ব সাকুল্যে মোট ৭৪৮০ মেগাওয়াট ইউনিট এখনো পর্যন্ত এফজিডি লাগানোর জন্য বিড প্রদান করেছে এবং মোট ৫১০ মেগাওয়াট ইউনিটকে চিহ্নিত করা হয়েছে যা কিনা আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হবে। কাজেই এই সব ইউনিটগুলোকে সালফার ডাই-অক্সাইডের অপসারণ নিয়ন্ত্রণ করার প্রযুক্তি প্রয়োগের ব্যাপারে ছাড় দেওয়া হয়েছে। ফলে বাকি রইল ৪০ শতাংশ অর্থাৎ ৫৬৯৫ মেগাওয়াট ইউনিট, যা সালফার ডাই-অক্সাইডের (এসও ২ SO2 ) অপসারণ কমানোর জন্য এখনো পর্যন্ত কোন উদ্যোগ নেয়নি, সংশ্লিষ্ট রিপোর্ট টি তুলে ধরে এমনি তথ্য।
সালফার ডাই-অক্সাইডের অপসারণ কম করতে পারলে মোট বায়ু দূষণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে যখন কয়লা এবং অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানি জ্বালানো হয় তখন সেখান থেকেই তৈরি হয় সালফার ডাই-অক্সাইড নামক একটি গ্যাস। বাতাসে উপস্থিত পার্টিকুলের ম্যাটার (পিএম ২.৫ ) বা অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণার একটা বড় অংশ এই সালফার ডাই-অক্সাইডের সঙ্গে অন্যান্য দূষিত পদার্থের প্রতিক্রিয়ার ফলে তৈরি হয়। এই পিএম২.৫ জাতীয় অতি সূক্ষা ধূলিকণা প্রতিবছর ভারত তথা বিশ্বের বহু মানুষের মৃত্যুর কারণ হিসেবে পরিচিত। কাজেই কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে সালফার ডাই-অক্সাইডের অপসারণ উৎসস্তরেই কমাতে পারলে রাজ্য এবং তার বাইরেও বায়ুদূষণের মাত্রা তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে হ্রাস পাবে।
সংশ্লিষ্ট রিপোর্টে দেখা গেছে যে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে উৎপাদিত দূষণের মাত্রা কিছু কিছু ইউনিটের ক্ষেত্রে ৮৬ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব, যা সালফার ডাই-অক্সাইডের অপসারণ কমানোর প্রযুক্তি প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্বকেই তুলে ধরে।
এফজিডি প্রয়োগ সংক্রান্ত পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণকারী নথি এবং বিভিন্ন সরকারি কাগজপত্র সবগুলোতেই বলা হয়েছে যে এই প্রযুক্তি প্রয়োগ করার জন্য ১৮ থেকে ৩৬ মাসের মতো সময় লাগে। এর অর্থ হল, কেন্দ্রীয় প্রকল্পাধীন (ডিভিসি) মেজিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সাত ও আট নম্বর ইউনিট, দুর্গাপুর স্টিল প্লান্টের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের এক ও দুই নম্বর ইউনিট এবং রঘুনাথপুরের এক এবং দুই নম্বর ইউনিট যারা ২০১৯ সালের জুলাই মাসে বিড প্রদান করেছিল, তারা সকলেই এই সময়সীমা (১৮ থেকে ৩৬ মাসের) অতিক্রান্ত করেছে। এবং শুধু তাই নয়, রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রযুক্তি প্রয়োগের সাথে যুক্ত যাবতীয় খুঁটিনাটি পদ্ধতিগত পরিবর্তনের কাজগুলোও হয় দেরি হয়েছে নতুবা বন্ধ হয়ে গেছে, যার ফলস্বরূপ সাধারণ মানুষের জন্য দূষণ সংক্রান্ত ভোগান্তির সূচনা হচ্ছে।
মেজিয়ার এক থেকে ছয় নম্বর ইউনিট যা কিনা ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিড প্রদান করেছিল, সেগুলিতে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে এফজিডি চালু হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্ত সেই দিক দিয়ে দেখতে গেলে এই সম্পূর্ণ পদ্ধতিটি তুলনামূলকভাবে খুবই ধীর গতিতে এগোচ্ছে এবং এই পুরো পদ্ধতির গতিবিধিতে সার্বিকভাবে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে, যা কিনা আরও বিলম্বের কারণ হয়ে উঠতে পারে, বিশেষ করে যেখানে এই প্রযুক্তি লাগানোর ঊর্ধ্বসীমা ২০২৬ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এনটিপিসি নিয়ন্ত্রণাধীন ফারাক্কা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ২০২০ সালের মে মাসে বিড প্রদান করা হয়েছিল।
বেসরকারি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলোর দূষণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরো খারাপ রাজ্যের বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন ইউনিটগুলির পরিস্থিতি আরও খারাপ, কারণ এরা সালফার ডাই-অক্সাইডের অপসারণ কমানোর ব্যাপারে এখনো পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। সরকারি নির্দেশিকা লাঘু হবার সাত বছর কেটে গেছে, কিন্তু তা সত্বেও কোন বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র এখনো পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি নিয়োগ করার জন্য প্রয়োজনীয় বিড প্রদান করেনি।
রাজ্য সরকারের অন্তর্গত ৩৯৭০ মেগাওয়াটের মধ্যে ৩০৭০ মেগাওয়াট প্রকল্প এখনো পর্যন্ত এফজিডি প্রযুক্তি লাগানোর বিড প্রদান করেনি। এটি দূষণ নিয়ন্ত্রণের প্রতি রাজ্য সরকারের প্রতিশ্রুতির অভাবকেই তুলে ধরে। পশ্চিমবঙ্গে একদিকে যেখানে রাজ্য, কেন্দ্র এবং বেসরকারি সকলের তরফেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের সময়ে অপসারিত দূষণ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বের অভাব দেখা দিয়েছে, তেমনি অন্য দিকে আবার গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে কয়লার ব্যবহার বাড়ছে। যার অর্থ হল, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বর্জ্যের কারণে বাতাসে দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পশ্চিমবঙ্গে গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে কয়লার ব্যবহার ২০১৫ সালের ৪৪ মেট্রিক টন থেকে বেড়ে ২০২১ সালে হয়েছে ৫৪ মেট্রিক টন - এমনটাই দাবি সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি এন্ড ক্লিন এয়ার (CREA) এবং বর্তমান রিপোর্টের লেখক সুনীল দাহিয়ার বর্তমানে আলোচ্য এই রিপোর্টটি দেখাচ্ছে যে বর্তমানে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দূষণ অপসারণ মাত্রা ৮৬% পর্যন্ত কমানো সম্ভব।
রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে বর্তমানে যে ইউনিট গুলি চালু রয়েছে সেখান থেকে নির্গমনের পরিমাণ হচ্ছে ৮০০ থেকে ১১০০mg/Nm31 এই ইউনিটগুলির আকার এবং ইউনিটগুলি চালু হবার স অনুসারে বিভিন্ন ইউনিট থেকে দূষণের মাত্রা ৮৬ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে যে দূষণ সংক্রান্ত তথ্য জনসমক্ষে আনার ব্যাপারে স্বচ্ছতার তীব্র অভাব রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ, কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন সংস্থাগুলি কেউই অনলাইনে ক্রমাগত দূষিত পদার্থ নির্গমনের পর্যবেক্ষণ স্বরূপ তথ্য প্রদানের যে ব্যবস্থা (ও সেমস) বর্তমানে রয়েছে, তা জনসমক্ষে প্রকাশ করছেনা।
সুনীল দাহিয়া আরো বলেন যে, “এই সংক্রান্ত স্বচ্ছ তথ্যের অভাব থাকায় যাবতীয় আইন প্রয়োগ করা কিংবা তাকে সঠিক দিশায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যারপরনাই মুশকিলের। কাজেই সালফার ডাই-অক্সাইডের অপসারণ কমানোর প্রযুক্তিও যেমন একদিকে খুবই জরুরী, তেমনি প্রকৃত সময়ে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে দূষিত পদার্থ নির্গমনের তথ্যও নিয়মিত ভাবে জনসমক্ষে নিয়ে আসা প্রয়োজন।”
রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে যে, “সর্বচ্চ্যো প্রয়োজনীয়তার তুলনায় রাজ্যের কাছে প্রায় ১০% অধিক উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে এবং রাজ্যের কোন একদিনের বা পুরো বছরের সর্বচ্চ্যো প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে (টোটাল এনার্জি টারমস) রাজ্যকে বরাদ্দ ১১১৩১ মেগাওয়াটের মধ্যে, ২০২১-২২ এ রাজ্যের